নিজস্ব প্রতিবেদক:
দীর্ঘ ২৩ বছর পরে ফেনীর চাঞ্চল্যকর মা-মেয়ের গণধর্ষণ মামলার পলাতক আসামি নুরুল আফসার প্রকাশ আফসার (৩৯) ঢাকার গাজীপুর থেকে আটক করে র্যাব ৭।
বুধবার (১৭ মে) ঢাকার গাজীপুর টংগী থেকে বিশেষ অভিযান চালিয়ে তাকে আটক করা হয়।
র্যাব ৭ এর সিনিয়র সহকারী মিডিয়া পরিচালক মোঃ নুরুল আবছার বলেন, ধর্ষিতা ভুক্তভোগী ভিকটিম একজন প্রবাসীর স্ত্রী। তার স্বামী গত ১৯৯৭ সাল থেকে কুয়েতে কর্মরত আছেন। নিরীহ ভিকটিম তার সন্তানাদি নিয়ে গৃহিনী হিসেবে নিজ বাড়িতে অবস্থান করত। ভিকটিমের ঘরে বিবাহ উপযুক্ত একটি মেয়ে থাকায় কতিপয় দুস্কৃতিকারী তাকে প্রায়ই বিভিন্ন অশালীন কথা বলে উক্ত্যক্ত করত। এ ব্যাপারে ভিকটিম গ্রামের গণ্যমান্য ব্যক্তিদের কাছে বিচার চেয়ে কোন প্রতিকার পাননি।
এরপর গত ২০০০ সালের রমজান মাসের ৫/৬ দিন পূর্বে ভিকটিম তার মেয়ের নিরাপত্তার কথা ভেবে তার পরিচিত জনৈক মুন্নার নিকট পাঠিয়ে দেন। কিন্তু উক্ত দুস্কৃতিকারীরা তার মেয়েকে খুন করবে বলে ধমক দিলে তখন মুন্না ভিকটিমের মেয়েকে পুনরায় তার বাড়িতে রেখে যায়।
পরবর্তীতে গত ৫ ফেব্রুয়ারি ২০০০ সালে রাত আনুমানিক ১টা ৩০ মিনিটের দিকে কতিপয় দুস্কৃতিকারীরা ৪/৫ জন সন্ত্রাসী নিয়ে ভিকটিমের বসত বাড়ির ভিতরে প্রবেশ করে এবং ঘরের টিন কেটে রুমে প্রবেশ করে। দুষ্কৃতিকারীদের দেখে ভিকটিম রুমের বাতি জ্বালিয়ে তার সন্তানসহ ডাকাত ডাকাত বলে চিৎকার করতে থাকে সে সময় দুস্কৃতিকারীরা তাদেরকে অনেক মারধর করে।
দুস্কৃতিকারীরা ভিকটিম এর বিবাহ উপযুক্ত মেয়েকে মারধর করে নির্যাতন করতে চাইলে ভিকটিম তখন দা দিয়ে তাদেরকে আক্রমন করার চেষ্টা করে। কিন্তু দুস্কৃতিকারীরা ভিকটিমের কাছ থেকে দা ছিনিয়ে নেয় এবং ভিকটিম ও তার মেয়েকে জোরপূর্বক তাদের ইচ্ছার বিরুদ্ধে পালাক্রমে গণধর্ষণ করে। অতঃপর গণধর্ষনকারীরা ভিকটিমের ঘরের জিনিসপত্র তছনছপূর্বক লুন্ঠন করে এবং এরুপ নির্যাতন ও গণধর্ষনের কথা কাউকে বললে খুন করবে বলে হুমকি দিয়ে ঘটনাস্থল থেকে পালিয়ে যায়। সে সময় ভিকটিম ও তার মেয়ে ঘরের বাতি জ্বলার কারণে গণধর্ষনকারীদের মধ্যে ৬/৭ জন আসামীকে দেখে চিনতে পারে।
উক্ত ঘটনায় ভুক্তভোগী ভিকটিম বাদী হয়ে ফেনী জেলার সোনাগাজী থানায় নুরুল আফসার প্রকাশ আফসারকে প্রধান এবং আরো ৭ জনকে আসামী করে নারী ও শিশু নির্যাতন আইনে একটি মামলা দায়ের করেন, যার মামলা নং- ১১(২) ২০০০ ইং, জিআর নং-৩২/২০০০, নারী ও শিশু ১৫/২০০০ ইং, ধারা-১৯৯৫ ইং সনের নারী ও শিশু নির্যাতন (বিশেষ বিধান) আইনের ৬(৩) ধারা। উক্ত অমানবিক, পাশবিক, নৃশংস ও নিকৃষ্ট চাঞ্চল্যকর ঘটনাটি সে সময় ফেনীসহ সারাদেশব্যাপী ব্যাপক আলোড়ন সৃষ্টি করে।
পরবর্তীতে মামলার এজারহার নামীয় প্রধান আসামী নুরুল আফসার প্রকাশ আফসারসহ অন্যান্য মোট ৭ জন এর বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠনের মধ্য দিয়ে মামলার বিচারকার্য শুরু হয়। গত ১৯ ফেব্রুয়ারি ২০০২ সালে বিজ্ঞ আদালত সমস্ত সাক্ষ্য প্রমানের ভিত্তিতে বিচারকার্য শেষে অভিযুক্ত ০৭ জন আসামীর বিরুদ্ধে যাবজ্জীবন সশ্রম কারাদন্ড রায় প্রদান করেন।
এর মধ্যে ৩ জন আসামী দীর্ঘদিন কারাভোগের পর মহামান্য হাইকোর্ট থেকে জামিন নিয়ে কারামুক্ত হন। সে সময় বাকী পলাতক চার আসামীর মধ্যে নুরুল আফসার ছিলেন একজন। মামলার পর থেকেই গ্রেপ্তার এড়াতে আসামী নুরুল আফসার সৌদি আরবসহ কয়েকটি দেশে আত্মগোপনে ছিলেন।
উক্ত অমানবিক, পাশবিক, নৃশংস ও নিকৃষ্ট ঘটনার প্রেক্ষিতে চাঞ্চল্যকর মা ও মেয়ে গণধর্ষন মামলায় বিজ্ঞ আদালত কর্তৃক রায় হওয়ার পর থেকে র্যাব-৭, চট্টগ্রাম বর্ণিত নারী ও শিশু নির্যাতন মামলার যাবজ্জীবন সাজাপ্রাপ্ত পলাতক আসামীদের গ্রেফতারের লক্ষ্যে গোয়েন্দা নজরদারি এবং ছায়াতদন্ত অব্যাহত রাখে। নজরদারীর এক পর্যায়ে র্যাব-৭, চট্টগ্রাম গোপন সূত্রের জানতে পারে যে, বর্ণিত নারী ও শিশু নির্যাতন মামলার যাবজ্জীবন সাজাপ্রাপ্ত আসামী আইন শৃংখলা বাহিনীর নিকট হতে গ্রেফতার এড়ানোর লক্ষ্যে ছদ্মনাম ধারণ করে গাজীপুর জেলার টংগী এলাকায় অবস্থান করছে।
উক্ত তথ্যের ভিত্তিতে র্যাব-৭ ও র্যাব-১৪ এর যৌথ অভিযানে বর্ণিত এলাকায় অভিযান পরিচালনা করে গত ১৭ মে আসামী নুরুল আফসার প্রকাশ আফসার (৩৯), পিতা- কালা মিয়া, সাং- ভাদাদিয়া, থানা- সোনাগাজী, জেলা- ফেনী’কে গ্রেফতার করতে সক্ষম হয়।
পরবর্তীতে উপস্থিত সাক্ষীদের সম্মুখে আটককৃত আসামীকে জিজ্ঞাসাবাদে জানা যায়, সে বর্ণিত মামলার যাবজ্জীবন সশ্রম কারাদন্ড এবং ৫ হাজার টাকা অর্থদন্ড অনাদায়ে আরো ৬ মাসের কারাদন্ড প্রাপ্ত পলাতক আসামী মর্মে স্বীকার করে।
গ্রেফতারকৃত আসামীকে জিজ্ঞাসাবাদে আরও জানা যায়, সে আইন শৃংখলা বাহিনীর নিকট হতে গ্রেফতার এড়াতে ছদ্মনামে ধারণ করে প্রায় দীর্ঘ ২৩ বছর নাম ও ঠিকানা পরিবর্তন করে প্রথমে সৌদিআরব অবস্থান করেন এবং সেখানে দীর্ঘ সময় বসবাস করেন। পরবর্তীতে দেশে এসে বিভিন্ন স্থানে বিভিন্ন পেশায় নিজেকে আত্মগোপন করে থাকলেও সর্বশেষ টংগীতে স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করেন। বর্তমানে সেখানে একটি ভাড়া বাসায় বসবাস করতঃ মোবাইল সার্ভিসিং এর কাজে নিজেকে নিয়োজিত করেছিলেন।
গ্রেফতারকৃত আসামীকে পরবর্তী আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণের নিমিত্তে সংশ্লিষ্ট থানায় হস্তান্তর করা হয়েছে।